শৈশবে মক্তবে : মনে পড়ে সেই দিনগুলো

সকালের সূর্য তখন চারদিক আলোকিত করেছে। আমি ঘুম থেকে ওঠে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি। উঠানের শেষপ্রান্ত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আমার চেয়ে বছর দেড়েক বড়ো এক চাচাতো ভাই। তার হাতে কায়দা বা কুরআন শরীফ ছিল। সে মক্তব থেকে ফিরেছে।

মহল্লার এক দাদি নতুন মক্তব দিয়েছেন। আমরা তাঁকে মক্তব-দাদি বলে ডাকি। তাঁর কোনো সন্তান নেই। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বাচ্চাদেরকে বিনামূল্যে কুরআন শেখানোর চেষ্টা করছেন। আগে ছেলে-মেয়েরা গ্রামের মাদরাসা-মক্তবে যেত, এখন আমাদের মহল্লার প্রায় সব বাচ্চারাই দাদির মক্তবে যেতে শুরু করেছে। এর একটি কারণ সম্ভবত মক্তব-দাদির বিনামূল্যে শিক্ষাদান। তিনি কুরআন শেখানোর বিনিময়ে কোনো পয়সা নেন না। বরং মাঝে মাঝে নিজের পয়সায় সুস্বাদু খাবারের আয়োজন করেন।

আমার চাচাতো ভাইকে সেদিন মক্তব থেকে ফিরতে দেখে মা আমাকে বললেন, ‘তুইও মক্তবে যাবি কাল থেকে।’

তখন আমার বয়স পাঁচ-ছয় বা কিছু কমবেশি হবে। ইতিপূর্বে কখনও মক্তবে যাইনি। অবশ্য চাচাতো ভাইদের সাথে একবার মাদরাসার মক্তবে গিয়েছিলাম দেখতে, পড়তে নয়। এবার দাদির মক্তবে যাচ্ছি শিখতে।

আমাদের বাড়ি থেকে ৩-৪ মিনিট লাগে মক্তব-দাদির বাড়ি যেতে। দাদির বাড়ি একটু নীরব জায়গায়। বাড়ির তিনদিকেই গাছপালা, বিশেষভাবে সামনের দিকে গাছের সারির পর ফসলের মাঠ। গাছ থেকে গাছে কাঠবিড়ালির দৌঁড়াদৌড়ি দেখা যেত মক্তবে বসেই। বাস্তবে আমি তখনই প্রথমবার কাঠবিড়ালি দেখেছিলাম। এখন অবশ্য আমাদের এলাকায় কাঠবিড়ালির জ্বালায় ফল-ফসল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

যাইহোক, দাদি তাঁর বাড়ির উঠানে মক্তব পড়ান। প্রথমদিন গিয়ে দেখি, পাঁচ-ছয়জন ছেলে-মেয়ে কাঠের তৈরি পিঁড়িতে বসে রয়েছে। আমিও একটি পিঁড়িতে বসলাম। আমরা ছিলাম দাদির প্রথম দিকের শিক্ষার্থী। ধীরে ধীরে ছাত্র-ছাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ায় এত পিঁড়ির যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সবাই ৫ টাকা করে দিয়ে দুটি বড়ো চট কিনে আনি।

মক্তব-দাদি ফজরের পর রেডিও শুনে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এরপর ঘর থেকে বের হয়ে একটি পিঁড়ি নিয়ে বসতেন বারান্দায়। আমরা সেখানে গিয়ে তাঁকে সবক শোনাতাম। তিনি বয়স্ক, চোখে কম দেখেন; আবার ছাত্র-ছাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ায় সবার সবক তিনি নিজে শোনার সময় পেতেন না। তাই, ছোটোদের সবক শোনার দায়িত্ব দিতেন বড়োদেরকে, বিশেষত যারা কুরআন শরীফ পড়তে পারে—তাদেরকে। আল্লাহর অনুগ্রহে আমি দীর্ঘদিন মক্তবে এই দায়িত্ব পালন করেছি। এমনকি বৃহস্পতিবারে, সাপ্তাহিক নামাজ শিক্ষার দিনে ইমামতির দায়িত্বও পালন করেছি আলহামদুলিল্লাহ। মনে পড়ে, মক্তব-দাদির নির্দেশে একবার সালাতুত তাসবিহ পড়িয়েছিলাম। সবাইকে নিয়ে সালাত আদায়ের কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছিল সেদিন।

মক্তব-জীবনের এমন বহু স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারিনি মক্তব-দাদির আন্তরিক ও মমতাময়ী শিক্ষাদানের কথা। দোয়া করি, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় যেন এমন মক্তব-দাদির আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের মমতাময়ী হাত-ধরে পবিত্র কুরআনের সাথে প্রথম পরিচয় হবে মুসলিম শিশুর।

Related Posts

19 Comments

Leave a Reply

⚠️

Ad Blocker Detected

Our website uses advanced technology to provide you with free content. Please disable your Ad Blocker or whitelist our site to continue.