বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠী।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে কিছু তথ্য। বাংলাদেশ বহু জাতি,সংস্কৃতি,ধর্ম এবং ভাষার দেশ।এদেশে বাংলা ভাষাভাষি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী রয়েছে।বাঙালিদের পাশাপাশি প্রাচীনকাল ধরে বসবাস করছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়। আচারে,অনুষ্ঠানে,ধর্মে,ভাষায়, সংস্কার-সংস্কৃতিতে এরা বাঙালিদের থেকে সতন্ত্র।এরা বাংলাদেশেরই অবিচ্ছেদ্য এবং অনিবার্য অংশ।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে।১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৯ টি জাতিসত্তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।যাদের বেশিরভাগই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে।২০০১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী দেখা গেছে বাংলাদেশে মোট অধিবাসীদের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭৫ জন।তবে বাংলাদেশের আদিবাসী ফোরামের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ৪৫ টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে এবং সর্ব মোট ২০ লক্ষাধিক আদিবাসী আছে বলে জানা যায়।বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – চাকমা,মারমা,রাখাইন, মনিপুরী,গারো,হাজং, সাঁওতাল,খাসিয়া প্রভৃতি নৃ-গোষ্ঠীগুলো।এরা বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবজার, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ,রংপুর, ঠাকুরগাঁ,সিলেট, পঞ্চগড়,রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে যুগ যুগ ধরে বাস করছে।

চাকমা : বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সর্ববৃহৎ সম্প্রদায় হলো চাকমা।চাকমারা নিজেদের কে বলে চাঙমা।বৃহত্তম পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি,বান্দরবান প্রভৃতি জেলায় এদের বাস। এরা আবার ছোটো ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত।এদের নিজস্ব সামাজিক,প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা আছে যার প্রধান দায়িত্বে আছে রাজা।রাজাই চাকমাদের সমাজ ব্যাবস্থা,প্রথা, রীতিনীতি নির্ধারণ,ভূমি, রাজস্ব ব্যাবস্থাপনা, গ্রামের কোন্দল এবং নানা সমস্যার নিষ্পত্তি করে।চাকমাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক।আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে চাকমাদের স্বাক্ষরতার হার (৩৭.৭%) সবচেয়ে বেশি।এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।এদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব গুলোর মধ্যে আছে মাঘী পূর্ণিমা,বৈশাখী পূর্ণিমা,বৌদ্ধ পূর্ণিমা,কঠিন চীবর দান,মধু পূর্ণিমা,ফানুস ওড়ানো ইত্যাদি।চাকমাদের অন্যতম বড় উৎসব হলো বিজু উৎসব।

মারমা : সংখ্যাগরিষ্ঠের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহৎ সম্প্রদায় হলো মারমা।এরা মূলত বান্দরবানের অধিবাসী।মায়ানমার থেকে এসেছে বলে এদেরকে মারমা বলা হয়।বান্দরবনে প্রায় এক লাখ মারমা বাস করে।চাকমাদের মত এদেরও সামাজিক বিচার -আচারের দায়িত্ব রাজার হতে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা হলেও মারমা মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকার লাভ করে। জুম চাষ,নদীর মাছ ও কাঁকড়া শিকার এবং কাপড়,চুরুট ইত্যাদি তৈরি করে এরা জীবিকা নির্বাহ করে।তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হয়ে এরা চাকুরী,ব্যবসাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে।মারমারা নিজস্ব ভাষায় কথা বললেও লেখার ক্ষেত্রে বার্মিজ বর্ণমালা ব্যাবহার করে।মারমারা বৌদ্ধ ধর্মাবল্বী।এদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মধ্যে আছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান,ওয়াগ্যোয়াই প্রভৃতি।

গারো : বৃহত্তর ময়মনিংহ জেলার মধুপুরের গভীর অরণ্য সংলগ্ন এলাকা এবং গারো পাহাড়ের টিলায় এদের বাস।এছাড়া নেত্রকোনা,টাঙ্গাইল ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কিছু কিছু গারোদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।নৃতান্ত্রিকগণ মনে করেন এরা মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর একটি শাখা।গারোরা নিজেদের আচ্ছিক মন্দি অর্থাৎ পাহাড়ের মানুষ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে।তবে যারা সমতলে বাস করে তারা কেবল মান্দি বলে পরিচয় দেয়। গারোদের ভাষার নাম অচ্ছিক ভাষা।তবে সমতলে বসবাসকারী গারোদের ভাষা আলাদা,তাদের ভাষার নাম মান্দি ভাষা।গারোরা স্বতন্ত্র ধর্মমতে বিশ্বাসী আর তাদের সংস্কৃতিক উৎসব,আচার অনু্ঠানের মূলে রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস।গারোদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব।

রাখাইন : রাখাইন সম্প্রদায় মূলত মায়ানমারের একটি জাতিগোষ্ঠী।পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশ ,রাঙামাটি ই বান্দরবান জেলায় রাখাইনদের বাস। রাখাইনরা মূলত মোগ নামে পরিচিত।এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।এদের প্রধান উৎসবগুলো হলো – বুদ্ধের জন্মবার্ষিকী পালন,বৈশাখী পূর্ণিমা,মাঘী পূর্ণিমা প্রভৃতি।পুরুষেরা লুঙ্গি,ফতুয়া আর নারীরা লুঙ্গি,ব্লাউজ ,অলঙ্কার এবং মাথায় ফুল পরিধান করতে পছন্দ করে।

সাঁওতাল : ভারতের এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম অধিবাসী জনগোষ্ঠী গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাঁওতাল।বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বিশেষত দিনাজপুর এবং রংপুরে সাঁওতালদের বাস। সাঁওতালদের প্রধান পেশা কৃষি। সাঁওতালদের প্রধান দেবতা বো়ংগা ।এরা মূলত দল বেঁধে নাচ করে। সাঁওতালদের প্রধান খাবার ভাত।।এছাড়া এরা মাছ, কাঁকড়া, শুকর,মুরগি,খরগোশ,গুইসাপ,ইদুর এবং বেজির মাংস খেতে পছন্দ করে। সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণে ইতিহাসে এরা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।

আলোচিত সম্প্রদায় ছাড়াও বাংলাদেশে ত্রিপুরা,খিয়াং, চক,লুসাই প্রভৃতি আরো কিছু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গলো এ দেশের নাগরিক।তাই তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের সংস্কৃতি,ইতিহাস,ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।বর্তমানে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলে আরো ব্যাপক পরিসরে তাদের ইতিহাস,ঐতিহ্য,রীতি-নীতি,জীবনযাপন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা হাওয়া প্রয়োজন ।এগুলো সংরক্ষণ করার যথাযথ ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

Related Posts

6 Comments

Leave a Reply

⚠️

Ad Blocker Detected

Our website uses advanced technology to provide you with free content. Please disable your Ad Blocker or whitelist our site to continue.