নন্দিনীর সাথে এক রাতে কবিতার কড়চা

নতুন ভাড়া বাসায়। সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন উপরে উঠছি তখনই দেখা পেলাম তোমার। বিস্মিত হয়েছি।
এ কী! নন্দিনী যে! মুখ থেকে কথাটা বিড়বিড় করে বেরোয়। কোনো কথা হয়নি তখন। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে হচ্ছিল খপ করে হাতটা ধরে ফেলি। তা কী করে হয়? অন্যসব দলছুট ইচ্ছের মতো এটিও আটকে রইল মনকুঠুরিতে।

এরপর তোমায় দেখি; বারবার। কখনো বারান্দায়, কখনো গেটে,কখনো সিঁড়িতে। কল এলো মোবাইলে। নাম্বারটা তাহলে রেখেছিলে? বললে,তোমাদের ফ্ল্যাটে যেতে। ইতস্তত করে গেলাম ধুকধুক করা বুক আর কাঁপা-কাঁপা হাঁটু নিয়ে। জানি,চোখে চোখ রাখার মতো শক্তি আমার নেই। কথাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ঘরের লোকেদের সামনে আমি মাথা নিচু করতে করতে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি। কেউ যদি না থাকত,তবে হয়তো ভিন্ন হত। হয়তো একশত প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে মারতাম মুখের উপর। চোখে চোখ রাখতাম সাহস করে;টপাটপ পানিও পড়ত হয়তো। কিছুই হলো না,শুধু ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করা ছাড়া।

ছাদে গেলাম। ফাল্গুনী বিকেল। কেউ নেই। দূরে দূরে হাঁটছি। পায়চারি করছি। বাসন্তী হাওয়া আঁচড় কাটছে গায়ে। কিন্তু ভেতরে ভ্যাপসা গরম; নিঃশ্বাস যেন গুমোট হাওয়া, স্যাঁতসেঁতে বদ্ধ ঘরের মতন। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালে। বললে,এই তুমি আসলেই ভাল আছ?
কী বলব ভেবে পাই না। মস্তিষ্কের প্রতি দরজায় কড়া নাড়ি। নাই,কোনো উত্তর নাই। মন বলছে চিৎকার করে বলি,তামাশা হচ্ছে,না?ছাইচাপা আগুনে ফেলে একটু একটু করে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়েছ। আর এখানে মশকরা হচ্ছে?
হঠাৎ কী যেন খেয়াল হল।বললাম,হ্যাঁ,বেশ আছি। তুমি আছ কেমন?
বললে,ভাল।
কিছু সময় নীরব থেকে বললে,কবিতা লেখ না এখন?
বললাম,লেখি তো। ধিক্কার,হতাশা,বিচ্ছেদ,যাতনা,ক্লেশ,ক্রোধ,উন্মত্ততা নিয়ে লিখি।
— বিষয়ের পরিবর্তন হল?
— কই? নাতো। আগে যা ছিল আনন্দ,খুশি,উল্লাশ,হাসি; সেগুলোই এখন ভিন্ন রূপে লিখি।
— আমার কথা লিখনি?
— তোমার কথা? কী লিখব?
— নাই কিছু লেখার মতন?
— ছিল কখনো?
— ওই যে স্তব্ধ বীথিকার মর্মর শব্দে শুনতে পাওয়া ডাক,আছি আমি পাশে তৃণাচ্ছাদিত এ আঙ্গিনাতে,তরী লয়ে দাঁড়ায়ে;সেগুলো?
— ওগুলোর কথা থাক। নিঃসঙ্গ অবসরে ঘুড়ি উড়ানোর সখ জেগেছিল হয়তো তখন।
— প্যাঁচিয়ে কথা বলার অভ্যাসটা যায়নি বোধ হয়?
— যাওয়ার মত কিছু?
— হয়েছে। থাক ও কথা।
— হ্যাঁ,সেই ভাল।

সন্ধ্যা নামল খানিক আগে। কথার ঘোরে টের পাইনি। চুপচাপ দু’জনে। মনে হল বহু ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে,তবে তা দ্রুতই। সাদা মতন একটা শাল জড়ানো তোমার গায়ে। দুই হাত বুকে বেঁধে হাঁটছ। আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। বড় বড় দালানগুলোতে বাতি জ্বলছে। সামনের রাস্তাটায় নিয়ন বাতি স্বপ্নালু আভা মেলে ধরেছে।আবার নীরবতা ভাঙলে তুমি,
—কী ভাবছ?
ভাবছি? কী ভাবছি? আসলেই কি ভাবছি কিছু? তড়িৎ কোনো উত্তর মাথায় এল না। বললাম,ভাবছি ওই বড় দালানটার ছাদ থেকে যদি রশিতে ঝুলে এই ছাদে আসি কেমন হবে।
— বদলালে না তুমি।
— বদল? বদল হয়েছে তো। বুঝতে পারছ না?
— নাহ্।
— অজানাই থাকুক তাহলে।

আকাশে ভরা পূর্ণিমা। ঝলমলে চাঁদ,ঠিকরে আলো বেরোচ্ছে। তাকালাম। দীর্ঘশ্বাস বেরোল যেন। বললে,এখানে শুবে। গায়ের শালটা বিছিয়ে,মাথার নিচে দুনো হাত। পাশাপাশি শুলেম। চাঁদ দেখছি। ভাবছি,আজকের রাতটা যেন শেষ না হয়। অন্ধকার নেই,তারাও আছে অনেক। তবুও পাশাপাশি দুটো আত্মার তারাদের মতোই যোজন-যোজন দূরত্ব। বললাম,নন্দিনী,কবিতার কথা বলছিলে যে?
তুমি বললে,থাক না ওসব কথা।
আমি শুধালেম, চুপ করে থাকব?
বললে,তুমি কবিতা আওড়াবে না।
— কেন?
— ওটা বড্ড ভারি। আমি ভার সইতে পারি না।
— নিষিদ্ধ জিনিসে আগ্রহ বেশি মানুষের।
— সবসময় না।
— তাই?
— হ্যাঁ,যদি জানে নিষিদ্ধ সে জিনিসটা তার মৃত্যুর নিশ্চিত কারণ তখন কেউ তাতে আগ্রহ দেখায় না।
— কী করে তাহলে?
— উল্টো দৌড় দেয়।
— আমি চলে যাব?
— কবিতা ছাড়া কি ভাষা নেই?
— অন্য ভাষার লোক আছে। কবিতার আর লোক নেই।
— তবুও।

আজকের রাতই শেষ। এরপর আর হয়তো দেখা হবে না। অন্ধকার হয়ে যাবে চোখ। স্তব্ধ হয়ে যাবে চারপাশ। হারিয়ে যাবে তুমি মহাকালের অতল গহ্বরে। ফাগুনের রাতে আকাশে মেঘ করে, শুনেছ কখনো? চাঁদটা দেখো ঢেকে যাচ্ছে বারবার। বাতাসের দৌড়ানিও যেন বাড়ল খানিক। অদ্ভুত তো। এই সময়ে ঝড় হয়?হোক। বৃষ্টিতে ভিজব নাহয় দু’জনে। উঠে দাঁড়ালে কেন? ঝিরঝির বৃষ্টি। ঘরে চলে যাবে? চলো ভিজি। হাওয়ার তোড় বাড়ছে। সেই সাথে বৃষ্টিও। মেঘের ডাকও শোনা গেল। কাছে কোথাও বাজ পড়ল যেন। হঠাৎ কানের পাশে তীব্র আওয়াজ হল। মনে হচ্ছে,শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে অনেক। তোমাকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেভাবেই আছি। তুমিও। শরীর অবশ। নড়তে পারছি না।পাশের বিল্ডিং থেকে চিৎকার এল,বাজ পড়েছে,বাজ। বেঁচে আছি কি? প্রচণ্ড জ্বালা ধরেছে শরীরে। খুব চেষ্টা করছি পা’টা নাড়াতে,চোখ খুলতে। পারছি না।

হঠাৎই ঝাঁকি লাগল যেন। ধরমড় করে উঠে বসলাম। চোখ কচলিয়ে দেখি অপূর্ব দাঁড়ানো সামনে। ডাকছে আমাকে। স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ? আমি মেঝেতে ঘুমিয়েছি কখন? অপূর্ব বলছে,কী রে,জানাযায় যাবি না?
জানাযা? কার? কখন? পরক্ষণেই মনে পড়ল,নন্দিনী মারা গেছে।হাসপাতাল থেকেই অপূর্ব ফোন করেছিল। আমার মাথাটা থেমে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল,একটা দেয়াল ছুটে আসছে আমার দিকে।আসলে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছিলাম।

অপূর্ব আমাকে ধরে দাঁড় করাল। মুখে পানির ছিটা দিয়েছে। গোসল করতে হবে। জানাযায় যেতে হবে। গোরস্থানে যেতে হবে।অনেক কাজ। টলতে টলতে হাঁটছি আমি।

Related Posts

10 Comments

Leave a Reply

⚠️

Ad Blocker Detected

Our website uses advanced technology to provide you with free content. Please disable your Ad Blocker or whitelist our site to continue.