ঝুম বর্ষা, আবেগী সাগর কিংবা নিশি ম্যাডামের গল্প

এক.
নারায়নগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের দেলপাড়া হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সাগর। রোল নম্বর আঠার। বয়সে কিশোর হলেও সাগরের মনের মাঝে বেয়াড়া আবেগের অবাধ আনাগোনা। আর কিছু বুঝুক না বুঝুক সুন্দরী মেয়ে দেখলে সে তার অন্তরে এক স্পন্দন অনুভব করে। স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা নিশি ম্যাডাম পারিবারিক দৈন্যতার কারণে কোন রকমে গ্রাজুয়েশন শেষ করেই এ স্কুলে যোগ দিয়েছেন। নিশি আপাার অপার সৌন্দর্য সাগরের কাছে সূর্য্য আড়াল করার মতো মনে হয়। মনে মনে সেনিশি ম্যাডামের প্রেমে হাবুডুবু খায়। বাংলা ক্লাসে সে প্রথম বেঞ্চে বসে অপলক তাকিয়ে থাকে ম্যাডামের মুখের দিকে। অথচ বাংলায় সে বরাবরই কম নাম্বার পায়। কারণ একটাই, বাংলা ক্লাসের পড়া তার কানে ঢোকে না।

সে শুধু নিশি ম্যাডামকে দেখে আর দেখে। বিষয়টি খেয়াল করে একদিন ম্যাডাম ওকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা তুই আমার দিকে এভাবে তাকাই থাকিস কেন? কিছু না বুঝেই সাগর বলে, আপনাকে আমার ভালোলাগে, তাই। ম্যাডাম একটু ভিমড়ি খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কাল থেকে স্কুল ছুটির পর তুই আমার সঙ্গে যাবি। আমাকে বাসায় পৌছে দেয়ার পর তোর ছুটি। কথাটা শুনে সাগর কতোটা খুশি হয়েছে তা ওর চেহারা দেখেই আাঁচ করতে পারলো ম্যাডাম। পরের দিন স্কুল ছুটির পর একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে কুল-বড়ই বের করে ম্যাডামের দিকে এগিয়ে দেয় সাগর। ম্যাডাম দেখে অবাক হয়ে বলে,
আমার জন্যে এনেছিস?
সাগর ‘হ্যা’ সূচক মাথা নাড়ে।

আজ টিফিন খেয়েছিস?
সাগর ‘না’ সূচক মাথা নাড়ে।
আর কোনদিন আমার জন্যে কিছু আনবি না, কেমন?
সাগর সম্মতি সূচক সূচক মাথা নাড়ে।

দুই.
বৃহস্পতিবার দুপুর দুইটায় স্কুল ছুটি হলে সাগর-নিশি ম্যাডাম এক সঙ্গে বাড়ির পথ মাড়ায়। আষাঢ়ের আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা, প্রবল বাতাসে দুলছে ধান ক্ষেত। নীল শাড়িতে আজ নিশি আপাকে দারুন লাগছে।
সাগর দেখ, আজ আকাশে একটুও নীল নেই।
থাকবে কি করে, সবটুকু নীল তো আপনি শরীরে জড়িয়ে রেখেছেন।
সাগরের কথায় দ্বিতীয়বারের মতো বিস্মিত ম্যাডাম বলে, চল আজ বৃষ্টিতে বিজবো। এমন সময় ঝুম বৃষ্টি। ভিজতে ভিজতে ম্যাডাম বলে, আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো না।

কোথায় যাবেন?
একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাবো, বুঝলি?
এমনভাবে কথাগুলো বললো সে, যেন সে তার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
সাগর মন খারাপ করে মাঠের পাশের একটি বাড়ির কার্ণিশের নিচে দাঁড়ায়। ম্যাডাম ধীরে এসে তার পাশে দাঁড়ায়।
আমি কোথাও যাবো না। এমনি বলেছি। আমার দিকে তাকা, তাকা বলছি…
সাগর অভিমানি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ওর চাহনিতে ম্যাডামের হাত দুটো ধরে অন্তত এক ঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজার আকুতি।
একদিন তোর আকুতি আমি পূরন করবো।

সত্যি বলছেন?
হ্যা।
এই বর্ষা, এই বৃষ্টির কসম খেয়ে বলেন
এই বর্ষা, এই বৃষ্টির কসম খেয়ে বললাম।
আপনি যদি কথা না রাখেন তবে আগামী বর্ষায় ভালো থাকবেন না।
ম্যডাম ওর কথায় মুচকি হাসে। ওরা আবার বুষ্টিতে নামে।

তিন.
এক বছর পরের কথা। ম্যাডাম সাগরকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্ঠা করে। একদিন সে শোনে ম্যাডাম নারায়রগঞ্জ শহরের একটি স্কুলে চাকরি নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সে ভালোবেসে ওই স্কুলের এক শিক্ষককে বিয়েও করেছে। তখন আষাঢ় মাস। মাঝ রাতে বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঠে চলে যায় সে। বৃষ্টির মাঝে দু’হাত পেতে বিড়বিড় করে বলে, সাক্ষী থাকিস বৃষ্টি, সাক্ষী থাকিস বর্ষা, কথা রাখেনি নিশি ম্যাডাম।

চার.
সপ্তাহ খানেক পর স্কুলের টিচার্স রুমে নিশি ম্যাডামকে দেখে চমকে ওঠে সাগর। সে আর আগের মতো সুন্দরী নেই। চোখের নীচে কালি পড়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অসুস্থ্য। এক সময় বাংলা ক্লাস নিতে আসে সে। সাগর সেদিন মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। ছুটির পর দু’জন এক সঙ্গে হাঁটতে থাকে।
তুই বলেছিলি না কথা না রাখলে এ ই বর্ষায় আমি ভালো থাকবো না? আমি ভালো নেই রে। যাকে জীবণে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসলাম, বিয়ে করে জীবণ সাজাতে চাইলাম তার কিনা আগের স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। ওয়াক থু! ফেলে চলে আসছি সব। তুই আমাকে ক্ষমা করিস।

সাগর কোন কথা বলে না।
আজও আকাশে মেঘ করেছে। ম্যাডামের শরীরে সেই নীল শাড়ি। আজ কি তার সঙ্গে সাগরের বৃষ্টিতে ভেজা উচিত? আজও কি বুষ্টিতে ভিজে ওকে নতুন কোন আশ্বাস দেবে নিশি ম্যাডাম? আজকের বৃষ্টিতে কি সাগরের সবটুকু অভিমান আর নিশি ম্যাডামের কষ্ট ধুয়ে যাবে? নাকি আষাঢ়ের বৃষ্টিতে সবুজ তৃণলতার মতো তা তরতরিয়ে বেড়ে উঠবে।

Related Posts

19 Comments

Leave a Reply

⚠️

Ad Blocker Detected

Our website uses advanced technology to provide you with free content. Please disable your Ad Blocker or whitelist our site to continue.