আমাদের সন্তানেরা……….

প্রকৃতির নিয়মে শিশু একটু একটু করে অভ্যস্ত হয় চারপাশের সাথে। টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন শক্ত পায়ে ছুটতে শিখে। চিনতে শিখে ভাল কিংবা মন্দ।

আমাদের এখনকার সময়ের শিশুরা অনেকটাই বঞ্চিত  আপন জনের স্নেহ ভালোবাসা থেকে। যৌথ পরিবার ভাঙ্গনের কারন এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী। একেতো একক পরিবার, তারপর যদি হোন বাবা মা দুজনেই চাকুরীজীবী তাহলেতো শিশুটির দুর্ভাগ্যের কোন অন্ত থাকে না। গৃহকর্মীর লাঞ্ছনা, গঞ্জনায় দিনভর কাটে তার খেলনা পুতুল, গাড়ি, লগো সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে  কিংবা বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনে।

অথচ যৌথ পরিবারের শিশুটি দিব্যি দাদা দাদীর চোখের সামনে কিংবা চাচা ফুফুদের আদর শাসনে জীবনের সুন্দর সময়গুলো অতিবাহিত করে। এক ছাদের নীচে থাকার ফলে বুঝে মায়া মমতা আর একাত্মতার টান।

মা চাকুরীজীবী  হোন বা না হোন, সন্তান সবার মধ্যে বড় হলে যে উন্মুক্ততার, উদারতার স্বাদে বড় হয় তা একক পরিবারে কোনভাবেই সম্ভব নয়।
তাইতো একটি বা দুটি সন্তান থাকা একক পরিবারগুলির দিনমান কাটে সন্তানের খাবারের বাটি হাতে। সকালের নাস্তার বাটির চারপাশ  শুকিয়ে কড়কড়ে হবার পর যখন ফুরোয়, ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুরের খাবারের সময় জানান দেয়।
পর্যায়ক্রমে এভাবেই চলে সকাল থেকে রাত অবধি সময় ক্ষেপনের ধারাবাহিকতা।
সন্তান শিখে খাবারের প্রতি অনীহা প্রদর্শন। কারন খাবারের মজাটা দিনে দিনে তার কাছে হয়ে ওঠে শীতল, পানসে, স্বাদহীন অনাকর্ষনীয় এবং বাধ্যতামুলক শাস্তিসম।

অন্যদিকে যে বাচ্চাটি সবার মধ্যে যৌথ পরিবারে  বেড়ে ওঠছে খাবার টেবিলে বড়দের পাশে নিজের প্লেট সামনে নিয়ে নিজেই খাবার নেবার জন্য তাগাদা দিচ্ছে, বড়দের সাথে পাল্লা দিয়ে মজা পাচ্ছে।
হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো করছে, নষ্ট করতে চাইছে খাবার। কিন্তু বড়রা যখন আদরে আদরে  বুঝিয়ে বলছে, ওর কৃতিত্ব বানিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছে তখন সে ঠিকই চেষ্টা করছে দুষ্টুমি বিরতির। সংগে অন্য বাচ্চারা থাকলেতো এই কাজটা আরও এক ধাপ এগিয়ে থাকে।  দিনের পর দিন সে নিয়মটায় অভ্যস্ত হয়ে একসময় এভাবেই বড় হতে শিখে যায় আনন্দধারার মাঝে।

অন্য দিকে একক পরিবারের বাচ্চাটি একাকীত্বের নিয়মের বেড়াজালে বন্দীত্বকে বরণ করে। স্কুল, কোচিং প্রাইভেট এসবের বাইরের জীবনটা তার অধরা থেকে যায়। এটাতো অবশ্যই ঠিক, বর্তমানটা প্রতিযোগীতার। না ছুটলেই পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই সমান তালে ওরা ছুটছে, এগোচ্ছে। একক কিংবা যৌথ যেখানেই থাকুক না কেন।
শুধু ক্লান্তিটা শেয়ার করার ব্যাপারে যৌথ পরিবারের সন্তানটি যে পরিবেশটা হাতের কাছে  পাচ্ছে, তা একক পরিবারের ছেলেটি ঘরের নির্দিষ্ট  কোনে মনের ভার বৃদ্ধি করে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে, নিজের বিকাশকে।

একাডেমিক ফলাফলে হয়তো  কেউ কম যায় না, এটাও ঠিক। পড়াশুনা নিজের আগ্রহের ব্যাপার।সদিচ্ছটাকে রূপায়ন করার ব্যাপার। কিন্তু মনের বিষয়টা অন্তরালে থেকেই যায়। মানসিক প্রশান্তির যে অনুভুতি তা শুধু অনুভবের। অন্তরের গভীরে এর প্রভাব বিস্তৃত।
আসলে বর্তমান সময়টাই পার করছি আমরা পুরনোকে মাড়িয়ে। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। ছোট হচ্ছে ঘরের কোন, তালে তাল মিলিয়ে সংসার ছোট, বাড়ি ছোট। ছোট হয়ে যাচ্ছে রান্নাঘর, ছোট হয়ে যাচ্ছে বিশাল হাড়িগুলোও। চারপাশে ছোট দেখতে দেখতে মনকেও ক্ষুদ্র করে ফেলছি আমরা।  এত ছোট যে মনগুলোতে  শান্তি স্বস্তির সংকুলান হচ্ছেনা অনেক ক্ষেত্রেই। আর তাই,  শান্তি স্বস্তিকে বাদ দিয়েই এগুচ্ছে আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত। যা পরিহার করতে হবে এখনই। পরিস্হিতির কারনে পরিবেশের চাপে কিংবা পুরনোকে আঁকড়ে ধরবার প্রয়াস নয়, আমরা নতুনকে স্বাগত জানাবো আমাদের সুন্দরগুলোকে রেখেই। বিশাল মাঠ, মস্ত উঠোন বিলুপ্ত হচ্ছে হোক না, অন্তরে রাখবো মায়া মমতার বন্ধন। হাতের মুঠোয় পৃথিবীটার ভাল দিকগুলোর ব্যবহার করে টিকিয়ে রাখবো আমাদের একাত্মতা,  আমাদের ভালোবাসা। একে অপরের সুখে দুঃখের ভাগীদার। আমাদের শপথ হবে ভালোকে স্বাগত জানানোর আর মন্দকে বর্জনের।

  • আমদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠুক আমাদেরই গড়ে দেয়া শান্তির ছায়াতলে, বাসযোগ্য পরিসরে।

Related Posts

6 Comments

Leave a Reply

⚠️

Ad Blocker Detected

Our website uses advanced technology to provide you with free content. Please disable your Ad Blocker or whitelist our site to continue.